ভারতের সবচেয়ে রহস্যময় গ্রাম যেখানে পাখিরা আত্মহত্যা করতে আসে!

রাতের অন্ধকারে কেন শতাধিক পাখি মৃত্যুর দিকে ছুটে যায়?

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছোট্ট গ্রাম জাটিঙ্গা বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মাঝে আলোচনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর আগস্ট থেকে নভেম্বর মাসে এখানে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে - শত শত পাখি রাতের অন্ধকারে আলোর দিকে ছুটে এসে আত্মঘাতী মৃত্যুবরণ করে। স্থানীয়রা এই ঘটনাকে "পাখির আত্মহত্যা" বলে অভিহিত করলেও বিজ্ঞানীরা এর পেছনে বেশ কিছু প্রাকৃতিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন।

জাটিঙ্গা কোথায়?

জাটিঙ্গা গ্রামটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২,২০০ ফুট উচ্চতায় বোরাইল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত। এই অঞ্চলটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। নিকটতম শহর হাফলং থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। গ্রামটি ঘন বনাঞ্চলে ঘেরা এবং এখানকার আবহাওয়া সাধারণত আর্দ্র ও শীতল থাকে।

কী ঘটে এখানে?

এই অদ্ভুত ঘটনা সাধারণত শীতের শুরুতে ঘটে থাকে, বিশেষ করে আগস্ট থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে এই ঘটনাটি দেখা যায়। প্রধানত রাজকুঁজি, টাইগার বিটার্ন, পন্ড হেরন এবং কিছু স্থানীয় পাখির প্রজাতি এই আচরণ প্রদর্শন করে। তারা বিভিন্ন রকম আলোর উৎসের দিকে ছুটে এসে আশেপাশের বাড়ি, গাছ বা বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ধাক্কা খায় এবং মারা যায়।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

বিজ্ঞানীরা এই ঘটনার কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ খুঁজে পেয়েছেন:

১. আবহাওয়ার প্রভাব

এই সময়ে কুয়াশা ও বৃষ্টি পাখিদের দিকনির্দেশনা নষ্ট করে, তাই তারা বিভ্রান্ত হয়ে আলোর দিকে উড়ে আসে।

২. চৌম্বকীয় বিভ্রান্তি

কিছু গবেষক বলছেন, এখানে ভূ-চৌম্বকীয় অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে যার ফলে পাখিরা তাদের প্রাকৃতিক কম্পাস (map) হারিয়ে ফেলে।

৩. পাখিদের শারীরিক অবস্থা

বিজ্ঞানীদের মতে, শুধুমাত্র দুর্বল বা তরুণ পাখিরাই এই আচরণ করে। তারা হয়তো দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, অথবা শারীরিক দুর্বলতা তাদের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি নষ্ট করে দেয়। সুস্থ পাখিরা সাধারণত রাতে উড়ে না।

স্থানীয় লোকেদের মতামত

স্থানীয় ডিমাসা ও জেমা নাগা উপজাতিদের মধ্যে এই ঘটনা নিয়ে নানা বিশ্বাস প্রচলিত। অনেকে মনে করেন এটি অশুভ আত্মার কাজ, আবার কেউ কেউ এটিকে দেবতার অভিশাপ বলে বিশ্বাস করেন।

আগে স্থানীয়রা এই পাখি সংগ্রহ করে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করত, কিন্তু বর্তমানে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে এই অভ্যাস কমে এসেছে।

পর্যটন ও গবেষণা কেন্দ্র

জাটিঙ্গা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন ও গবেষণা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় বন্যপ্রাণী সংস্থা এখানে একটি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেছে। পর্যটকদের জন্য বিশেষ ভিউয়িং পয়েন্ট তৈরি করা হয়েছে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে এই ঘটনা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

সংরক্ষণ প্রচেষ্টা

স্থানীয় প্রশাসন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থাগুলো নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। রাতে অপ্রয়োজনীয় আলো কমাতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বিশেষ পর্যটন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। পাখি সংরক্ষণে গবেষণা প্রকল্প চালু করা হয়েছে এবং স্থানীয় সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করে সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

বিশ্বের অন্যান্য স্থানে অনুরূপ ঘটনা

জাটিঙ্গা ছাড়াও বিশ্বের কয়েকটি স্থানে অনুরূপ ঘটনা দেখা যায়। ইসরায়েলের মাউন্ট কারমেলে পাখিদের দিকভ্রষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটে। আমেরিকার লেক ইরিতে কিছু নির্দিষ্ট আবহাওয়ায় পাখিদের বিভ্রান্তি দেখা দেয়। সিঙ্গাপুরের কিছু অঞ্চলে উচ্চ ভবনের আলোতে পাখি ধাক্কা খায়।

শেষ কথা

জাটিঙ্গার পাখি আত্মহত্যার রহস্য এখনও সম্পূর্ণভাবে সমাধান হয়নি। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এটি কোনো একটি কারণ নয়, বরং একাধিক প্রাকৃতিক ঘটনার সম্মিলিত ফলাফল। এই ঘটনা আমাদের প্রকৃতির জটিলতা এবং প্রাণীজগতের রহস্য সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়। আপনি যদি রহস্য প্রেমী হন, তাহলে এই গ্রাম আপনার জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে!

আপনার কী মনে হয়? এই পাখিদের আচরণের পিছনে কী কারণ থাকতে পারে? কমেন্টে জানান!

Comments