প্রকৃতি আমাদের সবসময়ই অবাক করে। কখনো তার সৌন্দর্য দিয়ে, কখনো বা তার অদ্ভুত সব সৃষ্টি দিয়ে। আজ আমরা এমনই একটি প্রকৃতিক বিস্ময় নিয়ে আলোচনা করবো - বিশ্বের সবচেয়ে তেতো খাবার। শুনতে সাধারণ লাগলেও এই খাবারটি এতই তেতো যে একবার খেলে মুখে তার তেতো স্বাদ প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে থাকে। এটি কোনো রাসায়নিক পদার্থ নয়, বরং একটি সাধারণ মাশরুম, যার নাম "বিটার ব্র্যাকেট"।
বিটার ব্র্যাকেট মাশরুমের পরিচয়
এই মাশরুমটির বৈজ্ঞানিক নাম Postia stiptica। এটি দেখতে ছোট এবং বাদামি রঙের হয়ে থাকে। সাধারণত গাছের গুঁড়ি বা মৃত কাঠের উপর জন্মায়। ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার বনাঞ্চলে এটি বেশি দেখা যায়। প্রথম দেখায় এটি সাধারণ কোনো মাশরুম বলে মনে হলেও এর বিশেষত্ব লুকিয়ে আছে এর স্বাদে।
কীভাবে আবিষ্কার হলো এই তেতো স্বাদ
ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস থেকে তেতো পদার্থ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এই গবেষণার অংশ হিসেবে তারা বিটার ব্র্যাকেট মাশরুমটি পরীক্ষা করেন। প্রথমে মাশরুমটিকে শুকিয়ে সূক্ষ্ম পাউডারে পরিণত করা হয়। এরপর এই পাউডারকে সামান্য জলে মিশিয়ে স্বাদ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা হয়।
একদল স্বেচ্ছাসেবক এই পরীক্ষায় অংশ নেন। তারা মাশরুমের এই নির্যাস খাওয়ার পরই বুঝতে পারেন এটি কতটা তেতো। মজার বিষয় হলো, এই তেতো স্বাদ তাদের মুখে প্রায় ৩০ মিনিট ধরে স্থায়ী হয়েছিল! সাধারণ কোনো তেতো জিনিস খেলে কয়েক মিনিট পরেই স্বাদ চলে যায়, কিন্তু এই মাশরুমের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
কেন এত তেতো?
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে এই মাশরুমে *stipatic acid* নামক একটি বিশেষ রাসায়নিক যৌগ থাকে। এই যৌগটিই মাশরুমকে এতটা তেতো করে তোলে। প্রকৃতিতে এই তেতো স্বাদের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। এটি মূলত মাশরুমটির জন্য একটি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে।
প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী, বেশিরভাগ প্রাণী এবং পোকামাকড় তেতো স্বাদ পছন্দ করে না। তাই এই তেতো স্বাদের কারণে পোকামাকড় এবং অন্যান্য প্রাণী এই মাশরুম খেতে আগ্রহী হয় না। এভাবে মাশরুমটি নিজেকে রক্ষা করে। এটি প্রকৃতির একটি চমৎকার অভিযোজন কৌশল।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ
আমরা সাধারণত যেসব তেতো জিনিস খাই, যেমন করলা বা কফি, সেগুলোর সাথে এই মাশরুমের তুলনা করলে দেখা যায়:
- একটি সাধারণ করলার তুলনায় এই মাশরুম প্রায় ৫০ গুণ বেশি তেতো
- কফির চেয়ে এটি প্রায় ১০০ গুণ বেশি তিক্ত
- এমনকি কুইনাইন (ম্যালেরিয়ার ওষুধে ব্যবহৃত হয়, যা খুব তেতো) এর চেয়েও এটি বেশি তেতো
এই তুলনা থেকে বোঝা যায় যে এই মাশরুমের তেতো স্বাদ কতটা extreme পর্যায়ের।
মানুষ বা প্রাণীর জন্য কি এটি বিপজ্জনক?
এখানে একটি ভালো খবর হলো - এই মাশরুমটি বিষাক্ত নয়। অর্থাৎ এটি খেলে কারো মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে খারাপ খবর হলো - এর তেতো স্বাদ এতটাই বেশি যে কেউ ইচ্ছা করে এটি খেতে চাইবে না।
প্রাণীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কোনো প্রাণীই সাধারণত এই মাশরুম খায় না। শুধুমাত্র কিছু বিশেষ পোকা, যারা এই রাসায়নিকের প্রতি সহনশীল, তারা কখনো কখনো এটি খেতে পারে।
এই মাশরুমের ব্যবহার
যদিও এটি খাওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়, তবুও কিছু ক্ষেত্রে এই মাশরুম ব্যবহার করা হয়:
ঐতিহ্যবাহী ঔষধ
কিছু সংস্কৃতিতে এই মাশরুমকে ঔষধি গুণসম্পন্ন মনে করা হয়। বিশেষ করে ইউরোপের কিছু অঞ্চলে এটি পেটের সমস্যা সমাধানে ব্যবহার করা হতো।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা এই মাশরুমের রাসায়নিক যৌগ নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে যে এই যৌগ ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারে। তবে এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ের গবেষণা।
প্রাকৃতিক কীটনাশক
এই মাশরুম থেকে প্রাপ্ত রাসায়নিক যৌগ প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা চলছে।
মজার তথ্য
এই মাশরুম সম্পর্কে কিছু মজার তথ্য জানলে আপনি আরও অবাক হবেন:
১. এই মাশরুম রাতের বেলা হালকা সবুজ রঙের আলো বিকিরণ করতে পারে। এই ঘটনাকে বায়োলুমিনেসেন্স বলে।
২. এটি শুধু তেতোই নয়, এর গন্ধও বেশ তীব্র। কেউ কেউ বলেন এটি পোড়া প্লাস্টিকের মতো গন্ধযুক্ত।
৩. এই মাশরুমের তেতো স্বাদকে "অবিশ্বাস্য তেতো" (incredibly bitter) বলে বর্ণনা করা হয়েছে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে।
শেষ কথা
প্রকৃতি কত বিচিত্র আর আশ্চর্য! একটি ছোট, সাধারণ দেখতে মাশরুমই হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে তেতো খাবার। এই মাশরুম আমাদের দেখায় যে প্রকৃতি কতটা নিখুঁতভাবে তার প্রতিটি সৃষ্টিকে বিশেষ গুণে ভরপুর করে তোলে।
Comments
Post a Comment