সকালবেলা যদি গরম গরম সুজির হালুয়া সামনে থাকে, তাহলে তার গন্ধেই মন ভরে যায়। কখনো আমরা খাই সুজির উপমা, আবার কখনো বানাই কেক বা লাড্ডু। কিন্তু কখনো কি আপনি ভেবেছেন, এই সুজিকে ইংরেজিতে কি বলা হয়?
ভারতে মোগল আমলে হালুয়া বানাতে সুজির প্রচলন শুরু হয়। মন্দিরে প্রসাদ হিসেবে আজও সুজির হালুয়া তৈরি হয়। আধুনিক যুগে এসে এটি শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক দেশেও ব্যবহার হয়।
সুজি এমন এক খাবার, যা আমাদের শৈশব থেকে প্রিয়। সকালবেলায় মায়ের হাতে বানানো গরম সুজির হালুয়া খেতে খেতে ছোটবেলার স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। শীতে, বৃষ্টিতে, বা হালকা অসুস্থতার সময়, এক বাটি সুজি যেনো ওষুধের মতো কাজ করে। এই সাধারণ অথচ চিরচেনা খাবারটি আমাদের জীবনের কত রকম অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তা বলে শেষ করা যাবে না।
কিন্তু, এই পরিচিত 'সুজি' আসলে কী? কোথা থেকে আসে? কেন এটি এত জনপ্রিয়? এবং, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, ইংরেজিতে এর নাম কী? চলুন ধাপে ধাপে জেনে নিই।
সুজি কীভাবে তৈরি হয়?
সুজি হলো গম থেকে তৈরি একটি মোটা দানার আটা। সাধারণত গমকে প্রথমে ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে নেওয়া হয়। তারপর সেটিকে পিষে যখন আটার মতো করা হয়, তখন বিভিন্ন স্তরের দানা বের হয়, মিহি আটা, মাঝারি দানা, এবং মোটা দানা।
এই মোটা দানাই হচ্ছে সুজি। এর টেক্সচার সাধারণত সামান্য দানাদার হয়, যা হাতের ছোঁয়ায় বোঝা যায়।
সুজির ইতিহাস ও রন্ধনসংস্কৃতি!
প্রাচীন মিশর, রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে ভারতবর্ষ, সব জায়গাতেই গম মানুষের প্রধান খাদ্যশস্যের মধ্যে একটি। গম থেকে তৈরি বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে সুজি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ভারতীয় উপমহাদেশে সুজির জনপ্রিয়তা বহু শতাব্দী ধরে। হালুয়া, উপমা, পায়েস, লাড্ডু, এত ধরণের রান্নায় সুজি ব্যবহার হয় যে, রান্নার বই খুললেই দেখা যায় সুজির আলাদা অধ্যায় থাকে!
সুজির উপকারিতা!
অনেকে ভাবেন সুজি শুধু ভাজাভুজির উপকরণ, তাই স্বাস্থ্যকর নয়। কিন্তু তা নয়।
১. সুজিতে প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট থাকে, যা শরীরে দ্রুত শক্তি সরবরাহ করে। সকালে খাওয়ার জন্য এটি একদম উপযুক্ত।
২. সুজির দানাদার গঠন এবং আঁশ (fiber) হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে। কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করে।
৩. সুজিতে কিছুটা পরিমাণে আয়রন থাকে, যা শরীরে রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে।
৪. এটি প্রাকৃতিকভাবে ফ্যাট-ফ্রি এবং এতে ক্যালোরির পরিমান খুব কম। তাই ডায়েট করার সময়ও সুজি খেলে উপকার পাওয়া যায়।
৫. অনেক বাবা-মা শিশুর প্রথম শক্ত খাবার হিসেবে সুজি বেছে নেন। কারণ এটি হালকা, সহজপাচ্য এবং পুষ্টিকর।
সুজির জনপ্রিয় কিছু রান্না!
সুজি দিয়ে এত ধরণের রান্না করা যায় যে একে “রান্নাঘরের ম্যাজিক উপকরণ” বললেও চলে। সুজির সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, এটি সব রকম রান্নায় মানিয়ে যায়। মিষ্টি, ঝাল, শুকনো, ভেজা, সব কিছুতেই জমে।
সুজির হালুয়া: ঘি, চিনি আর সুজির অসাধারণ সংমিশ্রণ। উৎসব থেকে দুঃখের সময়, সব মুহূর্তেই সুজির হালুয়া মানসিক শান্তি এনে দেয়।
সুজির উপমা: দক্ষিণ ভারতীয় জনপ্রিয় নাস্তা। সবজি আর সুজি মিশিয়ে তৈরি হয় হালকা, পুষ্টিকর ও সুস্বাদু উপমা।
সুজির কেক বা পুডিং: ডিম, চিনি ও দুধের সঙ্গে সুজি মিশিয়ে তৈরি হয় একধরনের ডেজার্ট, যা সন্ধ্যায় চা এর সাথে একদম আদর্শ।
সুজির চিলা বা ঝাল প্যানকেক: অল্প তেলে ভাজা, সবজি মিশ্রিত সুজির প্যানকেক, যারা ডায়েট করছেন তাঁদের জন্য।
সুজির লাড্ডু: গুঁড়ো দুধ ও ঘি দিয়ে তৈরি এক মজাদার মিষ্টি। পুজো, বিয়ে বা যে কোনো উৎসবে খাওয়া হয়।
ভিন্ন দেশে ভিন্ন রূপে সুজি!
মধ্যপ্রাচ্যে সুজি দিয়ে তৈরি হয় 'বসবুসা' বা 'হারিসা', একধরণের সুগন্ধি সিরাপে ভেজানো মিষ্টি কেক, যা
রমজান বা বিশেষ অনুষ্ঠানে একটি অভিজাত মিষ্টি হিসেবে পরিবেশন করা হয়।
ইতালির স্প্যাগেটি ও পাস্তা তৈরিতে ব্যবহৃত হয় আসলে সুজিই। এর মোটা দানার গঠন পাস্তার জন্য একে আদর্শ করে তোলে।
নাইজেরিয়া, ঘানা বা ইথিওপিয়ায় এটি দিয়ে তৈরি হয় পাতলা পোরিজ জাতীয় নাস্তা। স্থানীয়রা একে “pap” বা “bouillie” বলে ডাকেন, বিশেষ করে শিশুদের জন্য।
ব্রিটেনে সুজি দিয়ে তৈরি হয় ‘pudding’, একধরনের দুধ-চিনির মিষ্টি। শিশু ও বৃদ্ধদের পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে এটি ব্যাপক প্রচলিত।
দক্ষিণ ভারতে সকালের নাস্তায় তৈরি হয় উপমা, খিচুড়ি ও রাভা দোসা, সবই এই রাভা বা সুজি দিয়ে।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সুজি দিয়ে তৈরি হয় হালুয়া, লাড্ডু, কিংবা পায়েস। উৎসব ও পূজোর ভোগে এটি একেবারে অপরিহার্য।
তাহলে... সুজির ইংরেজি নামটা কী?
এখন আসা যাক মূল প্রশ্নে, এতক্ষণ ধরে যে খাবার নিয়ে এত আলোচনা করলাম, তার ইংরেজি নাম হচ্ছে Semolina (সেমোলিনা)। এই শব্দটি এসেছে ইতালীয় শব্দ semola থেকে, যার অর্থ ‘মোটা গমের গুঁড়ো’। এটি সাধারণত ডিউরাম গম থেকে তৈরি হয়।
Semolina নামেই এটি আন্তর্জাতিক বাজারে পরিচিত। অনেক দেশেই সুজির প্যাকেটের গায়ে সরাসরি “Semolina” বা “Durum Semolina” লেখা থাকে।
Comments
Post a Comment