অনেকে ভাবেন, প্রথম অ্যানিমেটেড ফিচার ফিল্ম তৈরি হয়েছিল হলিউডে। কিন্তু সত্যি ঘটনা জানলে আপনি চমকে যাবেন! জানুন এই সিনেমার আসল ইতিহাস।
অ্যানিমেটেড ফিল্ম মানেই ডিজনি?
আজকাল অ্যানিমেটেড সিনেমা মানেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে ডিজনির রঙিন জগৎ, ‘ফ্রোজেন’, ‘দ্য লায়ন কিং’, ‘মোয়ানা’, কিংবা ‘জুটোপিয়া’। ছোট থেকে বড় সবাই এই ধরনের সিনেমা পছন্দ করে। অনেকেই ভাবেন, এই অ্যানিমেটেড ফিচার ফিল্ম তৈরির যাত্রা শুরু হয়েছিল আমেরিকার হলিউডে, বিশেষ করে ডিজনির হাত ধরে।
কিন্তু আসলে ব্যাপারটা একেবারে ভিন্ন! অ্যানিমেশনের ইতিহাস অনেক পুরোনো এবং চমকপ্রদ। বিশ্বের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেটেড ফিচার ফিল্ম তৈরি হয়েছিল আর্জেন্টিনায়, দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশে।
হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন! ডিজনি বা আমেরিকায় নয়, অ্যানিমেশনের ইতিহাসে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা তৈরি হয় বুয়েনোস আইরেস, আর্জেন্টিনার রাজধানীতে।
সেই সিনেমার নাম কী ছিল?
বিশ্বের প্রথম অ্যানিমেটেড ফিচার ফিল্মটির নাম ছিল El Apóstol (এল আপোস্তল)। এই নামটি স্প্যানিশ ভাষার, যার বাংলা অর্থ “প্রেরিত পুরুষ” বা “The Apostle”।
এই সিনেমাটি তৈরি হয়েছিল ১৯১৭ সালে। তখন অ্যানিমেশন ছিল একেবারে নতুন ও পরীক্ষামূলক একটি মাধ্যম। প্রযুক্তি ছিল সীমিত, কম্পিউটার ছিল না, এমনকি ডিজিটাল কোনো পদ্ধতিও ছিল না। তবুও, একদল প্রতিভাবান মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করে তৈরি করেন এই ঐতিহাসিক সিনেমাটি।
এই সিনেমাটি বানিয়েছিলেন কে?
এই সিনেমার নির্মাতা ছিলেন Quirino Cristiani (কুইরিনো ক্রিস্টিয়ানি)। তিনি একজন ইতালীয় বংশোদ্ভূত আর্জেন্টাইন অ্যানিমেটর ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁর জন্ম ইতালিতে হলেও তিনি ছোটবেলাতেই পরিবারসহ আর্জেন্টিনায় চলে আসেন এবং সেখানেই বড় হয়ে ওঠেন।
Cristiani খুব কম বয়স থেকেই অ্যানিমেশন ও চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী, সৃজনশীল এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকেও অনেক এগিয়ে। 'El Apóstol' ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ও সাহসী প্রজেক্ট।
সিনেমার দৈর্ঘ্য ও পদ্ধতি
‘El Apóstol’ ছিল প্রায় ৭০ মিনিটের, যা অনেকটা এখনকার সাধারণ সিনেমার মতোই। এই সিনেমার জন্য প্রায় ৫৮,০০০ হ্যান্ড-ড্রাউন অ্যানিমেশন ফ্রেম তৈরি করা হয়েছিল।
Cristiani এই সিনেমাটি তৈরি করেন cut-out animation পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে চরিত্রদের দেহের আলাদা আলাদা অংশ কেটে নিয়ে তাদের আলাদা করে নাড়ানো হয়। এটি ছিল তখনকার দিনের এক বিশেষ ধরণের অ্যানিমেশন কৌশল, কারণ তাতে পুরো চরিত্র বারবার আঁকার দরকার হতো না।
সিনেমাটি ছিল সাদা-কালো এবং মূক (soundless), কারণ তখনো সাউন্ড ফিল্ম তৈরি শুরু হয়নি। শব্দ ও সংগীত সিনেমাতে যুক্ত হয় কয়েক বছর পরে।
সিনেমার গল্প ও বিষয়বস্তু
‘El Apóstol’ ছিল একটি রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক সিনেমা। সিনেমার প্রধান চরিত্র ছিল তৎকালীন আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট Hipólito Yrigoyen।
সিনেমার কাহিনীতে দেখানো হয়, প্রেসিডেন্ট স্বপ্নে স্বর্গে যান এবং সেখান থেকে বজ্রের শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে ফেরেন। এরপর তিনি আর্জেন্টিনার সমস্ত দুর্নীতি ও সমস্যাকে ধ্বংস করেন।
এই গল্প মূলত ব্যঙ্গের মাধ্যমে রাজনৈতিক অব্যবস্থার কড়া সমালোচনা করে। সেই সময়ে রাজনৈতিক বিদ্রূপকে জনপ্রিয়ভাবে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে তুলে ধরার এমন সাহসী উদ্যোগ সত্যিই বিরল ছিল।
তখনকার যুগে এটা কত বড় অর্জন ছিল?
১৯১৭ সাল মানে এক শতাব্দীরও বেশি আগে। তখনকার দিনে এমন একটি দীর্ঘ অ্যানিমেটেড ফিল্ম বানানো মানে ছিল বিশাল এক চ্যালেঞ্জ।
• তখন কোনো কম্পিউটার ছিল না।
• অ্যানিমেশন বানাতে প্রতিটি ছবি হাতে আঁকতে হতো।
• সিনেমার ফ্রেমগুলো ক্যামেরা দিয়ে একটি একটি করে ধারণ করতে হতো।
• কাহিনিচিত্র থেকে শুরু করে মুভমেন্ট তৈরি, সেট ডিজাইন, সবকিছু করতে হতো একেবারে হাতে হাতে।
এই সিনেমার জন্য দিনে ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। একসাথে অনেক কারিগর, শিল্পী ও চিত্রকর মিলে এই বিশাল কাজটি শেষ করেন মাত্র ১০ মাসে!
সিনেমাটি এখন কোথায়? দেখা যায় না কেন?
সবচেয়ে দুঃখজনক তথ্য হলো, ‘El Apóstol’ সিনেমাটির একটিও প্রিন্ট এখন আর বেঁচে নেই।
১৯২৬ সালে Cristiani-এর স্টুডিওতে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ড হয়। সেই আগুনে পুড়ে যায় সিনেমার সব নেগেটিভ, প্রিন্ট এবং রেকর্ড।
ফলে আজ আমরা এই সিনেমাটি দেখতে পারি না, শুধু এর ইতিহাস পড়ে বা ছবি দেখে কিছুটা ধারণা করতে পারি।
তাহলে ডিজনির সিনেমাগুলোর স্থান কোথায়?
অনেকে মনে করেন ডিজনির ‘Snow White and the Seven Dwarfs’ (১৯৩৭) ছিল প্রথম অ্যানিমেটেড ফিচার ফিল্ম। এটা আসলে ভুল নয়, কারণ এই সিনেমাটি ছিল প্রথম সাউন্ড ও রঙিন অ্যানিমেটেড ফিচার ফিল্ম।
তবে কালানুক্রমিকভাবে Cristiani-এর তৈরি ‘El Apóstol’-ই ছিল সবচেয়ে পুরোনো এবং প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেটেড সিনেমা।
ডিজনি অবশ্যই অ্যানিমেশনকে জনপ্রিয় ও বাণিজ্যিক করে তুলেছিল, কিন্তু তার অনেক আগেই Cristiani ইতিহাস তৈরি করেছিলেন।
Cristiani-এর অন্য কাজগুলো কী ছিল?
Cristiani ‘El Apóstol’ ছাড়াও আরও দুটি উল্লেখযোগ্য অ্যানিমেটেড ফিল্ম তৈরি করেছিলেন:
১. Sin dejar rastros (১৯১৮) - এটি ছিল বিশ্বে প্রথম সেন্সরড অ্যানিমেটেড ফিল্ম।
২. Peludópolis (১৯৩১) - এটি ছিল বিশ্বের প্রথম সাউন্ড অ্যানিমেটেড ফিচার ফিল্ম।
দুঃখজনকভাবে, এই সিনেমাগুলোরও কোনো কপি আজ আর পাওয়া যায় না।
শেষ কথা
Cristiani-এর এই অবদান অনেক বছর ধরে অজানা থেকে গিয়েছিল। ইতিহাসে অনেক সময় এমন হয়, যারা পথ দেখান, তারা আলো পান না।
আমরা যখন ডিজনির অ্যানিমেশন দেখে আনন্দ পাই, তখন Cristiani-এর মতো অগ্রপথিকদের কথা মনে রাখা উচিত। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, সীমিত প্রযুক্তি, কম সুযোগ-সুবিধা থাকলেও যদি মনোবল, সৃজনশীলতা ও অধ্যবসায় থাকে, তাহলে অসম্ভবও সম্ভব হয়ে যায়।
Comments
Post a Comment