সিনেমা দেখার পর নিজের মধ্যে নায়ক নায়ক ভাব কেন আসে?

আপনি কি কখনও এমন অনুভব করেছেন, কোনও অ্যাকশন, রোমান্স বা থ্রিলার সিনেমা দেখার পর আপনি নিজেই যেন সেই সিনেমার হিরো? হয়তো সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে আপনি একটু ভিন্নভাবে হাঁটলেন, আয়নায় নিজেকে একটু অন্য চোখে দেখলেন, বা নিজের মধ্যে একধরনের আত্মবিশ্বাস অনুভব করলেন? এমনটা প্রায় সব পুরুষই কমবেশি অনুভব করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন?

এই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে বিজ্ঞান, আবেগ, এবং আমাদের মস্তিষ্কের কিছু অদ্ভুত কার্যকলাপ। আজ আমরা জানবো, কেন সিনেমা দেখার পর আপনি নিজেকে হঠাৎ করে ‘হিরো’ মনে করেন।

১. আইডেন্টিফিকেশন থিওরি!

মনোবিজ্ঞানে একে বলা হয় “Identification” মানে, আপনি যখন কোনো চরিত্রের সঙ্গে এতটা সংযুক্ত বোধ করেন যে মনে হয় আপনি নিজেই সেই চরিত্র।

সিনেমার হিরো সাধারণত হয়ে থাকেন:

  • সাহসী
  • আত্মবিশ্বাসী
  • নারীদের আকৃষ্ট করার ক্ষমতাসম্পন্ন
  • খলনায়ককে পরাজিতকারী
  • সামাজিকভাবে সম্মানিত

এসব গুণ আমাদের অনেকেরই কাঙ্ক্ষিত, বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে। ফলে যখন কোনো পুরুষ দর্শক এমন হিরোকে দেখে, সে তার নিজের অজান্তেই নিজের সঙ্গে চরিত্রটির মিল খুঁজে পায়।

মস্তিষ্ক বলে ওঠে: “এই তো! এটাই তো আমি হতে চাই। আমি-ই তো এটা।”

২. মস্তিষ্কের আয়না!

আমাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের নিউরন আছে যাকে বলে "Mirror Neurons"। এই নিউরনগুলো এমনভাবে কাজ করে, যেন আপনি যা দেখছেন সেটিই আপনি নিজে অনুভব করছেন।

উদাহরণস্বরূপ:

  • হিরো যখন কাউকে ঘুষি মারছে, আপনার মনে হয় আপনি নিজেই সেই ঘুষি মারছেন।
  • হিরো যখন প্রেমে পড়ছে, আপনি নিজের মধ্যেও সেই অনুভব খুঁজে পান।
  • সে যখন জয়ী হয়, আপনার বুকও গর্বে ফুলে ওঠে।

এই অনুভবগুলো বাস্তব না হলেও, মস্তিষ্কে এমন বাস্তব অনুভব সৃষ্টি করে, যেটা একধরনের ‘সিনেম্যাটিক ট্রান্স’ তৈরি করে।

৩. আধুনিক স্বপ্ন!

বিশেষ করে অ্যাকশন বা রোমান্টিক সিনেমাগুলো পুরুষদের ভেতরের গোপন ইচ্ছা বা ফ্যান্টাসি পূরণ করে:

  • শক্তিশালী হয়ে ওঠা
  • শ্রদ্ধা পাওয়া
  • ভালোবাসা অর্জন করা
  • অন্যদের চেয়ে আলাদা কিছু করা

হিরোর চরিত্রটি এইসব কিছু একাই অর্জন করে নেয়। ফলে আপনি সেই চরিত্রটিকে দেখে ভাবেন, “আমি চাই এইরকম হতে। আসলে আমি তো পারিই!”

এই আত্মবিশ্বাসটা সিনেমা শেষ হওয়ার পরেও কিছুক্ষণ স্থায়ী হয়, যা আপনাকে সেই “হিরো” ভাবনায় আবিষ্ট রাখে।

৪. হরমোনের খেলা!

সিনেমা দেখার সময়, বিশেষ করে যদি সেটা উত্তেজনাপূর্ণ হয়, তখন শরীরের ভিতরে ঘটে রাসায়নিক পরিবর্তন:

  • ডোপামিন: আনন্দের অনুভূতি তৈরি করে।
  • টেস্টোস্টেরন: আত্মবিশ্বাস ও আক্রমণাত্মকতার মাত্রা বাড়ায়।

এই হরমোনগুলো একসঙ্গে আপনার মধ্যে “আমি সব পারি” এইরকম একটা মনোভাব তৈরি করে। আপনি নিজেকে শক্তিশালী, বুদ্ধিমান এবং আকর্ষণীয় মনে করেন, একদম সিনেমার হিরোর মতো!

৫. বাস্তব জীবনে অসন্তুষ্টি!

আসুন সত্যি কথা বলা যাক, আমাদের অনেকেই নিজের জীবন নিয়ে খুশি নই। হয়তো চাকরি ভালো না, হয়তো সামাজিক অবস্থান অনিশ্চিত, হয়তো সম্পর্কগুলো ভঙ্গুর।

৬. কাল্পনিক জগতে আশ্রয়!

এমন অবস্থায় একটি সিনেমা আমাদের একটি কল্পনার জগতে নিয়ে যায়, যেখানে আপনি হিরো, আপনি সব সমস্যার সমাধান করছেন, সবাই আপনাকে সম্মান করছে।

এই সাময়িক মুক্তি ও গৌরবের অনুভূতি আমাদের মনে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রশান্তি দেয়।

. পুরুষদের ক্ষেত্রে এটা কেন বেশি হয়?

পুরুষদের মধ্যে সাধারণত “হিরো ভাবনা” বেশি কাজ করে। এর কারণ:

  • সমাজ পুরুষদের শক্তিশালী ও নির্ভীক হতে শেখায়
  • সিনেমায় অধিকাংশ চরিত্রে সাধারণত পুরুষ হিরোদেরই প্রাধান্য দিয়ে দেখানো হয়
  • পুরুষরা নিজেকে নিয়ে চ্যালেঞ্জ ও গর্ব অনুভব করতে বেশি আগ্রহী

ফলে, যখন তারা কোনও সিনেমায় একজন পুরুষ হিরোকে দেখে, তখন তারা সহজেই তাকে নিজের আদর্শরূপে গ্রহণ করে নেয়।

৮. কতক্ষণ স্থায়ী হয় এই “হিরো ভাবনা”?

এটা ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন। কেউ সিনেমা দেখার ৩০ মিনিট পরেই স্বাভাবিক হয়ে যায়, আবার কেউ কেউ ১-২ দিন পর্যন্ত সেই ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকেন।

তবে, বাস্তব জীবনের কাজ, দায়িত্ব, সম্পর্ক, সব কিছু আবার ধীরে ধীরে মানুষকে মাটিতে ফিরিয়ে আনে।

এটা কি খারাপ কিছু?

না, মোটেও না। বরং এই “হিরো ভাবনা” মাঝে মাঝে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে। কেউ কেউ সিনেমা দেখে ব্যবসা শুরু করে, জিমে যোগ দেয়, নিজের জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে।

তবে যদি কেউ পুরোপুরি বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, এবং নিজেকে সবসময় “হিরো” ভাবতে শুরু করে, তখন সেটা হতে পারে “Delusional Thinking”, যেটা মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা নির্দেশ করে।

শেষ কথা

সিনেমা আমাদের কেবল আনন্দ দেয় না, এটা আমাদের চিন্তাভাবনা, আবেগ, আত্মবিশ্বাস, এবং সামাজিক বোধেও প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে যখন আপনি নিজেকে সিনেমার হিরোর সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন, তখন আপনার মধ্যে এক ধরনের মানসিক উত্তরণ ঘটে, যেটা হতে পারে সাময়িক কিন্তু গভীর।

সুতরাং, পরের বার যখন আপনি সিনেমা দেখে “হিরো” বোধ করবেন, তখন বুঝে নিন, এটা আপনার মস্তিষ্কের এক অসাধারণ খেলা, এবং আপনি সেই খেলার অংশ হয়ে উঠেছেন।

Comments