আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এমন অনেক জিনিস রয়েছে, যেগুলো আমরা নিয়মিত ব্যবহার করি, কিন্তু সেগুলোর পিছনের কারণ বা বিজ্ঞানটা খুব একটা ভাবি না। ঠিক তেমনই একটি বিষয় হলো, টয়লেট ফ্লাশ বা কমোডে থাকা দুটি বোতাম। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, অনেক আধুনিক টয়লেট ফ্লাশে একসাথে দুটি বোতাম থাকে, একটা বড় আরেকটা ছোট।
তবে কেন এই দুটি বোতাম? কি কাজ করে এই বোতামগুলো? আর এদের মধ্যে পার্থক্যই বা কী?
আজকের এই ব্লগ পোস্টে আমরা জানব কোমডের ফ্লাশে দুটি বোতাম থাকার প্রকৃত উদ্দেশ্য, এর পিছনের বিজ্ঞান, অর্থনৈতিক দিক এবং কীভাবে এটি পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখে।
১. দুটি বোতামের ব্যবহারিক পার্থক্য
ফ্লাশের দুটি বোতামের উদ্দেশ্য হলো জলের সাশ্রয়। বড় বোতামটি সাধারণত বেশি জল ছাড়ার জন্য (প্রায় ৬ লিটার), আর ছোট বোতামটি কম জল (প্রায় ৩ লিটার) ছাড়ার জন্য।
বড় বোতাম ব্যবহার করা হয় যখন বেশি পরিমাণ বর্জ্য পরিষ্কার করতে হয়, আর
ছোট বোতাম ব্যবহার করা হয় তরল বর্জ্য বা অল্প পরিমাণ মলমূত্র পরিষ্কারের জন্য।
এই সিস্টেমকে বলা হয় "Dual Flush System"।
২. জলের অপচয় বন্ধ করতে অসাধারণ আবিষ্কার
একটি সাধারণ ফ্লাশ প্রতি বার প্রায় ৬ থেকে ১৩ লিটার পর্যন্ত জল ব্যবহার করে। ভাবুন তো, দিনে যদি ৪–৫ বার ফ্লাশ করা হয়, তবে একজন মানুষই প্রতিদিন ব্যবহার করছে ২৫–৫০ লিটার জল শুধুমাত্র ফ্লাশে!
তবে ডুয়াল ফ্লাশ সিস্টেম ব্যবহার করলে এই জলের অপচয় অনেকটাই কমানো সম্ভব। ছোট বোতাম ব্যবহার করলে অর্ধেকেরও কম জল খরচ হয়। গড়ে দেখা গেছে, এই পদ্ধতি ব্যবহারে প্রতি বছর একজন ব্যবহারকারী প্রায় ২০,০০০ লিটার জল সাশ্রয় করতে পারেন।
৩. ডুয়াল ফ্লাশের আবিষ্কার ও ইতিহাস
ডুয়াল ফ্লাশ সিস্টেম প্রথম আবিষ্কার করেন অস্ট্রেলিয়ান উদ্ভাবক ব্রায়ান হুইকেন ১৯৮০ সালের দিকে। অস্ট্রেলিয়ায় তখন জলের সংকট ছিল মারাত্মক, সেই প্রেক্ষিতেই এই সাশ্রয়ী ফ্লাশ সিস্টেমের আবিষ্কার। পরবর্তীতে এই পদ্ধতি এতটাই কার্যকর প্রমাণিত হয় যে, এটি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া এমনকি আমাদের উপমহাদেশেও এই ফ্লাশ সিস্টেম ব্যবহৃত হচ্ছে।
৪. কীভাবে কাজ করে এই দুই বোতাম?
ফ্লাশের ভিতরে একটি ডুয়াল ভলিউম মেকানিজম থাকে, যা নির্ধারণ করে কোন বোতাম চাপলে কতটুকু জল ছাড়া হবে।
- ছোট বোতাম চাপলে একটি ছোট ভাল্ভ খোলে, যার মাধ্যমে কম জল বের হয়।
- বড় বোতাম চাপলে পুরো ট্যাংকের জল একবারে বের হয়ে যায়।
এছাড়া অনেক ফ্লাশে একটি বোতাম একবার চাপলে অল্প জল আর একসাথে দুটি বোতাম চাপলে বেশি জল ছাড়া হয়, এই সিস্টেমও চালু রয়েছে।
৫. পরিবেশ বান্ধব উদ্ভাবন
আজকের দিনে যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন ও জলের অভাব এক গভীর সংকট, সেখানে ডুয়াল ফ্লাশ সিস্টেম সত্যিকারের একটি পরিবেশবান্ধব উদ্ভাবন। এই প্রযুক্তি শুধু ঘরোয়া পর্যায়েই নয়, অফিস, হোটেল, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হচ্ছে জলের অপচয় কমাতে।
জলের ব্যবহার যত কম হবে, ততই ভূগর্ভস্থ জলের স্তর ধরে রাখা সম্ভব। সেই সঙ্গে কম জলের ব্যবহারে নর্দমা ব্যবস্থার উপরও চাপ কমে।
৬. অর্থনৈতিক দিক থেকে সাশ্রয়ী
জলের খরচ কম মানে শুধু পরিবেশ রক্ষা নয়, বাড়তি বিল থেকেও মুক্তি। বিশেষ করে যেসব জায়গায় জলের মিটার ব্যবহার হয় বা জলের জন্য বাড়তি টাকা গুনতে হয়, সেখানে এই সিস্টেম খরচ অনেকটা কমিয়ে দেয়।
একটি পরিবার বছরে গড়ে ১,০০০–২,০০০ টাকা পর্যন্ত সাশ্রয় করতে পারে শুধু এই ডুয়াল ফ্লাশ ব্যবহারের মাধ্যমে।
৭. রক্ষণাবেক্ষণ সহজ এবং টেকসই
অনেকেই ভাবেন এই ফ্লাশ সিস্টেম হয়তো জটিল, কিন্তু আসলে তা নয়। এটি সাধারণ ফ্লাশের মতোই, শুধু ভাল্বের কাঠামো একটু আলাদা। বর্তমানের অধিকাংশ মডেল টেকসই এবং সহজেই পরিবর্তনযোগ্য অংশ নিয়ে তৈরি।
যদি কোনো সমস্যা হয়, খুব সহজেই প্লাম্বার বা নিজেরাই বোতাম বা ভাল্ব পরিবর্তন করতে পারেন।
৮. আমাদের দেশে এর গুরুত্ব আরও বেশি
ভারতের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে জলের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অনেক শহরে জলের স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রতিটি ফোঁটা জল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডুয়াল ফ্লাশ সিস্টেম এখন আমাদের দেশের অনেক নতুন ফ্ল্যাট, হোটেল ও অফিসে ব্যবহার হচ্ছে। তবে এটি আরও ব্যাপকভাবে প্রচলিত হওয়া দরকার।
৯. শিশুরা সহজেই শিখতে পারে এর ব্যবহার
অনেক বাবা-মা ভাবেন শিশুরা বুঝবে না কোন বোতাম কখন ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, একবার বুঝিয়ে দিলে শিশুরাও খুব সহজেই এই নিয়ম মেনে চলে। বরং তারা খুশি হয় বোতাম আলাদা দেখে এবং সচেতনতা গড়ে ওঠে ছোটবেলা থেকেই।
১০. ছোট কাজ, বড় পরিবর্তন
প্রতিদিনের ছোট্ট একটি সিদ্ধান্ত, কোন বোতাম টিপবো, সেটিই বড় একটি পরিবেশগত পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। আমরা যদি প্রতিদিন ফ্লাশে ছোট বোতাম ব্যবহার করার অভ্যাস করি, তবে বছরে হাজার হাজার লিটার জল বাঁচাতে পারি, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় উপকার বয়ে আনবে।
শেষ কথা
ডুয়াল ফ্লাশ সিস্টেমের দুটি বোতাম শুধু প্রযুক্তির অংশ নয়, বরং এটি সচেতনতার প্রতীক। জল সাশ্রয়, পরিবেশ রক্ষা ও খরচ কমানো, এই সব কিছুর সঙ্গে যুক্ত এই দুটি বোতাম।
তাই পরবর্তীবার টয়লেট ফ্লাশ করার সময় একটু ভাবুন, ছোট কাজ দিয়ে আপনি হয়তো বড় কিছু বাঁচাতে পারেন।
Comments
Post a Comment